Friday, November 14, 2025

‘সম্মান সমাধি’: মানবিক সেবার এক নতুন পথ এবং দেহ চাঁদা প্রথার অমানবিক বাস্তবতা


ডিগনিটি সমাধি উদ্যোগের সাফল্য   ও দেহ চাঁদার দুর্ব্যবহার ভবিষ্যৎ সংস্কারের প্রস্তাব

 . একটি সাফল্যের গল্প: মর্যাদার সঙ্গে শেষ বিদায়

এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপে কলকাতার খ্রিষ্টান সম্প্রদায় শুরু করেছেডিগনিটি বারিয়াল / সম্মান সমাধি’—একটি উদ্যোগ যা মৃত্যুর মুহূর্তেও প্রত্যেক মানুষকে সমান মর্যাদা দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। মল্লিকবাজারের ঐতিহাসিক ১৮৪ লোয়ার সার্কুলার রোড সেমিট্রিতে এর যাত্রা শুরু। এই উদ্যোগ শহরের এই বিশ্বাসকে জোরালো করেজন্ম যেমন গুরুত্বপূর্ণ, মৃত্যুও তেমন সম্মানের দাবিদার

যেখানে ধনীগরিব সকলেই সমান

কলকাতা ক্রিশ্চিয়ান বারিয়াল বোর্ড এই উদ্যোগে সমাধিস্থানের একটি অংশ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বরাদ্দ করেছে তাদের জন্যযাদের পক্ষে শেষকৃত্যের খরচ বহন করা অসম্ভব।
বোর্ডের মূলমন্ত্র
প্রত্যেক বিদায়ে মর্যাদা।

প্রাপ্তবয়স্ক তিন বছরের নিচের শিশুদের জন্য পৃথক অংশ রাখা হয়েছে; রক্ষণাবেক্ষণের সব দায়িত্ব বারিয়াল বোর্ড বহন করবে

ঐক্য, নাগরিক দায়িত্ব করুণার সম্মিলন

উদ্বোধনী দিনে ক্যালকাটা আর্চডায়োসিস থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রোটেস্ট্যান্ট স্বাধীন চার্চ নেতারা উপস্থিত ছিলেনদারিদ্রদের সেবায় খ্রিষ্টীয় ঐক্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফাদার মলয় ডিকোস্টা, এবং সাংসদ ডেরেক ব্রায়েন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। কোলকাতার  সাধ্বী মাদার  তেরেজার মিশনারিজ অব চ্যারিটি দুই সন্ন্যাসিনী ফিতা কেটে এই মানবিক কর্মসূচির সূচনা করেন

এমপিএলএডি ফান্ড থেকে ২০ লক্ষ টাকার অনুদান এই প্রকল্পের প্রতি সরকারি সমর্থনকে আরও দৃঢ় করেছে

মিশনারিজ অব চ্যারিটির মানবতা

এমসি সিস্টারদের প্রতিষ্ঠানে মৃত্যু অভিমুখে থাকা বহু মানুষ পরিত্যক্ত। তাদের অনেকেরই কেউ নেই।
এই উদ্যোগ সম্পর্কে ক্রিশ্চিয়ান বারিয়াল বোর্ডের ডেনিস স্মিথ বলেন
উদ্যোগ নিশ্চিত করছে যে তারাও শান্তি সম্মানের সঙ্গে শেষ বিদায় পাবে।

লোয়ার সার্কুলার রোডের পর বিস্তৃত হচ্ছে উদ্যোগ

২০২৬ সালের শুরুতেই টালিগঞ্জ সেমিট্রিতে দ্বিতীয়ডিগনিটি সমাধিচালু হবে।
সাথে রয়েছে নতুন খ্রিষ্টান সেমিট্রি তৈরির জন্য জমির আবেদনকারণ ব্রিটিশ আমলের সব সেমিট্রি প্রায় পূর্ণ

 জনমত: কৃতজ্ঞতা, আশাবাদ উদ্বেগ

প্রতিক্রিয়াগুলো উষ্ণ

• “২০২৫ সালের সেরা উপহারগরিব ভাইবোনদের জন্য আশীর্বাদ।
• “
বৃদ্ধাশ্রমে এই খবর পৌঁছে দিন।
• “
অল সোলস্ ডে-তে এই উদ্যোগের উদ্যোক্তাদের সালাম।

তবে পাশাপাশি সতর্ক কণ্ঠ
উদ্যোগ ভালো, কিন্তু এল.সি সেমিট্রির দুর্নীতি দালালি বন্ধ করতে হবে।

এই উদ্যোগ একদিকে প্রশংসা পেলেও অন্যদিকে সংস্কারের দাবি তুলেছে

. সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক অমানবিক বাস্তবতা: দেহ চাঁদার দুর্ব্যবহার, লিখছেন রেভারেন্ড ইম্মানুয়েল সিং

ডিগনিটি সমাধিশহরের গরিবদের জন্য সম্মানজনক সমাহিতকরণ নিশ্চিত করছে এক আশার আলো।

কিন্তু আলো যখন উজ্জ্বল হয়, অন্ধকারও স্পষ্ট হয়। আমাদের সমাজের সেই অন্ধকার দিকটির নামদেহ চাঁদা

শীতের মরশুম: মৃত্যুর সাথে লড়াই দেহ চাঁদার চাপ

নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিখ্রিষ্টান সম্প্রদায়ে মৃত্যুর হার বাড়ার সময়।
শোকাহত পরিবার প্রয়োজন করে সান্ত্বনা, করুণা, প্রার্থনা
কিন্তু অনেকেই প্রথমে মুখোমুখি হন একটি শকিং চাহিদার
চাঁদার বকেয়া মেটান, না হলে কবর দেওয়া যাবে না।

এক বাস্তব ঘটনা: রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতা

ঠাকুরপুকুরের এক পরিবারের দুর্দশা
তাদের বাবা মারা গেছেন হঠাৎ।
তিন কন্যা ভাবল, পাদ্রী সান্ত্বনা দেবেন।
কিন্তু প্রথম প্রশ্ন
দেহ চাঁদার বকেয়া কই?”

কফিন, কবর খরচ, হার্শসব মিলিয়ে পরিবারটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
শোকের মুহূর্তে হিসাবের খাতা যেন বিশ্বাস মানবিকতার পরাজয়

দেহ চাঁদার আসল উদ্দেশ্য আজকের সমস্যা

একসময় দেহ চাঁদা দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ছিল।
সামান্য দান থেকে শেষকৃত্যের খরচ মিটত।
কিন্তু আজ তা অনেক স্থানে মানবিক সেবার বদলে আর্থিক দাবি হয়ে উঠেছে

যাজক বা মণ্ডলী যখন আগে খোঁজেবকেয়া,”
তখন সেবা হয় বাণিজ্যিক, আধ্যাত্মিক নয়

সামাজিক নিরাপত্তা থেকে কুসংস্কার: এক বিপজ্জনক পতন

অনেক পরিবার মনে করে
টাকা না দিলে শেষকৃত্যও হবে না।
মৃত্যুকে ঘিরে এই ভয় খ্রিষ্টীয় শিক্ষার বিপরীত, যেখানে মুক্তি, শান্তি করুণাই মূল কথা

. ভবিষ্যতের পথ: কীভাবে পরিবর্তন সম্ভব?

ডিগনিটি সমাধিআমাদের দেখিয়েছে পরিবর্তন সম্ভব
তাহলে দেহ চাঁদা প্রথারও সংস্কার কেন নয়?

. বাধ্যতামূলক নয়, স্বেচ্ছাসেবী তহবিল : ধনী সদস্যরা চাইলে দান করবেন। গরিবরা কখনোই শোকের সময় টাকা দিতে বাধ্য হবেন না

. শেষকৃত্য ব্যক্তিগত নয়, মণ্ডলীর দায়িত্ব:  একজন বিশ্বাসীর শেষ যাত্রা একটি সামষ্টিক সেবা। কোনো পরিবারকে চাঁদার বকেয়ার জন্য অপমান করা অমানবিক

. আর্থিক শর্তহীন মাণ্ডলীক সেবা : যাজকীয় সেবা সর্বদা টাকার ঊর্ধ্বে হওয়া উচিত। মৃত্যুতে স্নেহ, প্রার্থনা সহমর্মিতাএই তিনটি হওয়া উচিত প্রথম প্রতিক্রিয়া

. উপসংহার: পরিবর্তনের অঙ্গীকার

একদিকেডিগনিটি সমাধিআমাদের সামনে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে
যেখানে প্রত্যেক মানুষ সমান সম্মানের অধিকারী

অন্যদিকে দেহ চাঁদাযা একসময় দরিদ্রদের জন্য নিরাপত্তা ছিল
আজ কখনো কখনো শোকের উপর বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়

একসময় উপকারী হলেও আজ দেহ চাঁদা অনেক ক্ষেত্রে শোষণ কুসংস্কারে পরিণত হচ্ছে।

কোনো দরিদ্র পরিবার যেন কখনো মৃত্যুর মুহূর্তে টাকার হিসাব মেলাতে বাধ্য না হয়

সময় এসেছে দুই সত্যকেই সামনে রেখে এগোনোর
মণ্ডলী যেন মানুষের বোঝা কমায়বাড়ায় না।
শোকের মুহূর্তে টাকা নয়, দরকার সেবা, ভালোবাসা সহমর্মিতা

কেউ যেন মর্যাদা ছাড়া এই পৃথিবী না ছাড়ে

এটাই হোক আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার 

No comments:

Post a Comment

CITIZENS, NOT SUBJECTS: RECLAIMING IT AMID ORCHESTRATED POLARIZATION

       Breaking Boundaries, Building Unity in Diversity Through True Patriotism   India, with her vibrant diversity, is facing a storm o...